বলা হয়, পার্থিব জীবনে অনেক কষ্টের মাঝে অন্যতম কষ্ট হচ্ছে- আপন মানুষের মৃত্যু। এই যন্ত্রণাকে স্বাভাবিক করা নিয়ে কাজ করছে মানুষ, যা সত্যিই অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত। এই অনাকাঙ্খিত কষ্টই কাঙ্খিত দোলনায় দোল খাচ্ছে।
সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসে এক দম্পতি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছেন। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা। এর পর বিবিসি বিষয়টার কারণ অনুসন্ধানে লেগে যায়। অনুসন্ধানে কোনো সমাধানসূত্র আসেনি।
বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা দরকার। বহু বিতর্ক শেষে দেশটিতে ২০০২ সাল থেকে শুরু হয় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ বা ইউথেনেশিয়া। নেদারল্যান্ডস ধনী দেশ, জনসংখ্যাও কম। সেখানে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ। দেশটিতে ইউথেনেশিয়া ‘টার্মিনেশন অফ লাইফ অন রিকোয়েস্ট অ্যান্ড অ্যাসিস্টেড সুইসাইড (রিভিউ প্রসিডিউরস) অ্যাক্ট’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা ২০০১ সালে পাস হয় এবং ২০০২ সালে কার্যকর হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে যে, ইচ্ছামৃত্যু এবং চিকিৎসকের সহায়তায় আত্মহত্যা শাস্তিযোগ্য নয় যদি উপস্থিত চিকিৎসক যথাযথ যত্নের মানদণ্ড অনুসারে কাজ করেন।
এই মানদণ্ডগুলো রোগীর অনুরোধ, রোগীর কষ্ট (অসহ্য এবং আশাহীন), রোগীকে দেওয়া তথ্য, যুক্তিসঙ্গত বিকল্পের অনুপস্থিতি, অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ এবং জীবন শেষ করার প্রয়োগ পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের সম্মতি প্রদর্শনের জন্য আইনে চিকিৎসকদের একটি পর্যালোচনা কমিটির কাছে ইউথানেশিয়া রিপোর্ট করতে হবে। ভাবতেও ভয় করে এ রকম একটি বিষয়।
মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু মৃত্যু কি কাম্য? যা হোক, এর পর থেকে ২০২০ সালে ২৬ জনকে প্রথমবারের মতো সঙ্গীর সঙ্গে মৃত্যুবরণের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০২১ সালে ৩২ জন। ২০২৩ সালে দেশটিতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৮ জন।
যদিও স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের জন্য মানতে হয় কিছু শর্ত, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে, অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা, আর কোনোভাবেই সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকা। কঠিনভাবে পরিস্থিতি যাচাইয়ের পর এই মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সহায়তায় কাজ করে পারিবারিক চিকিৎসক। যৌথভাবে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়- ডুয়োইউথেনেশিয়া।
নেদারল্যান্ডসে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণকারী দিয়েস ভ্যান অ্যাগোট ও স্ত্রী ইগুইনোর স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ এই ট্রেন্ডের অন্যতম উদাহরণ। তারা দু’জন হাতে হাত রেখে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। দ্রিয়েস ভ্যান অ্যাগোট ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মৃত্যুর সময় অ্যাগোট ছিলেন ৯৩ বছর বয়সের।
২৯ বছর বয়সী জোরায়া বিক মানসিক রোগে ভুগছিলেন। বিষণ্ণতা, হতাশা, ভয় কাজ করছিল। ভালো হবার সম্ভাবনা ছিল না। তাকেও স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের অনুমতি দেওয়া হয় যা সত্যিই অমানবিক। এই অমানবিকতাই আজ নিশিপদ্ম।
হত্যা পাপ, আত্মহত্যা মহাপাপ। এই মহাপাপই আজ বিশ্বকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। সত্যিই এ মৃত্যু ভয়ানক। আমাদের ধর্ম ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আল্লাহর বিধি-বিধানের প্রতি হুমকিস্বরূপ। জীবনে দুঃখ কষ্ট থাকবেই। যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা যার যত বেশি সে তত বেশি খাঁটি মানুষ হয়ে উঠার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আত্মহত্যার শামিল এই মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই কাম্য হওয়া উচিত না।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন্ত করেছেন। আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করবেন। পরিণামে তার দিকেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে।’ -সূরা আল বাকারা : ২৮
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের জীবন দান করেছেন। অতঃপর তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। এরপর (আবারও) তোমাদের জীবন্ত করবেন।’ -সূরা হজ : ৬৬
যেহেতু মহান আল্লাহ জীবন ও মৃত্যুর স্রষ্টা ও মালিক, তাই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে উত্তম জীবন ও মর্যাদাকর মৃত্যু কামনা করতে বলেছেন। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ দুঃখ-কষ্টে পতিত হওয়ার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি কিছু করতেই চায়, তা হলে সে যেন বলে, হে আল্লাহ! আমাকে জীবিত রাখো যত দিন আমার জন্য বেঁচে থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার জন্য মরে যাওয়া কল্যাণকর হয়। -সহিহ বোখারি : ৫৬৭১
ইসলামের বিধানে, প্রতিটা মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমরা জানি, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মটর নিউরন ডিজিসে ভুগছিলেন। যে রোগ তার মেরুদণ্ড ও স্নায়ুতন্ত্র অকেজো করে দিয়েছিল, কিন্তু তিনি তার জীবন ও স্বপ্নকে অকেজো করতে দেননি। তার মেরুদন্ড ভেঙে পড়েছিল কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। কাজেই আমরা স্বেচ্ছামৃত্যুকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারি না। বরং সবসময় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর রহমত কামনা করি। জীবনে যত দুঃখ কষ্ট আসুক হাসি মুখে বরণ করার শক্তি সৃষ্টি করি। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :