বিবিসি :
২০৫০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি শিশু-কিশোর ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টির হার সবচেয়ে বেশি এশিয়ায়।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন—অর্থাৎ তারা দূরের জিনিস স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না।
গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় লকডাউনে শিশুদের ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে। এ সময় তারা স্ক্রিনের সামনে বেশি সময় কাটিয়েছে, বাইরে সময় কাটিয়েছে কম। এটি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বেই ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়া এখন ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য-উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে কয়েক মিলিয়নে।
ক্ষীণদৃষ্টির হার সবচেয়ে বেশি এশিয়ায়। জাপানে ৮৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭৩ শতাংশ এবং চীন ও রাশিয়ায় ৪০ শতাংশের বেশি শিশু ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত।
অন্যদিকে প্যারাগুয়ে ও উগান্ডায় মাত্র ১ শতাংশ শিশু ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষীণদৃষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ১৫ শতাংশ।
ব্রিটিশ জার্নাল অভ অফথালমোলজিতে প্রকাশিত এ গবেষণায় ছয় মহাদেশের ৫০টি দেশের ৫ মিলিয়নেরও বেশি শিশু ও কিশোর-কিশোরীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ—শতকরা হিসাবে যা ৩৬ শতাং।
গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির পরে চোখে কম দেখা শিশুর সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, ‘বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো’।
মায়োপিয়া সাধারণত শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করার সময় থেকে আরম্ভ হয়। আর চোখের বিকাশ বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ক্ষীণদৃষ্টির অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার প্রবণতা চলতে থাকে।
মায়োপিয়া বেশি হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো পূর্ব এশিয়ায় বসবাস।
এছাড়া জিনগত কারণ—বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া রোগ—ও খুব কম বয়সে (২ বছর) পড়াশোনা শুরু করার ফলেও মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দ্বিতীয়টি বেশি দেখা যায় সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের মতো জায়গাগুলোতে।
এর অর্থ এই শিশুরা একেবারে অল্প বয়স থেকেই বই ও পর্দায় দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকে। ফলে তাদের চোখের পেশিতে চাপ পড়ে বেশি। এতে তারা ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে আফ্রিকায় শিশুরা ৬ থেকে ৮ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ফলে এশিয়ার তুলনায় আফ্রিকার শিশুদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সাতগুণ কম।
করোনা মহামারিকালে লকডাউনের সময় বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে। এতে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, তথ্য-প্রমাণ বলছে, মহামারি ও ক্রমেই শিশুদের দৃষ্টিশক্তির অবনতির মধ্যে একটি যজ্ঞসূত্র রয়েছে।
২০৫০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি শিশু-কিশোর ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হতে পারে বলে গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মেয়ে ও অল্পবয়সি নারীরা ক্ষীণদৃষ্টিতে বেশি আক্রান্ত হতে পারে। কারণ, বেড়ে ওঠার সময় তারা বাড়ি ও স্কুলে ঘরের বাইরের কার্যক্রমে কম সময় ব্যয় করে।
এছাড়া মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং বয়ঃসন্ধি ছেলেদের চেয়ে আগে শুরু হয়। এর অর্থ হলো, মেয়েশিশুদের ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত প্রবণতাও শুরু হয় তুলনামূলক বেশি কম বয়সেই।
যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার হার কমাতে প্রতিদিন অন্তত ২ ঘণ্টা বাইরে কাটানো উচিত, বিশেষ করে ৭ থেকে ৯ বছর বয়সি শিশুদের।
প্রাকৃতিক সূর্যালোক, ঘরের বাইরে ব্যায়াম করা বা দূরের বস্তুর ওপর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকা শিশুর দৃষ্টিশক্তি ভালো করার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
তবে যুক্তরাজ্যের কলেজ অভ অপ্টোমেট্রিস্টর ক্লিনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড্যানিয়েল হার্ডিম্যান-ম্যাককার্টনি বিবিসিকে বলেন, ‘শিশুদের জন্য ঘরের বাইরে সময় কাটানোর মধ্যে সত্যিকারের কিছু উপকার আছে।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বাবা-মায়েদের উচিত তাদের বাচ্চাদের সাত থেকে ১০ বছর বয়সে চোখের পরীক্ষা করানো, এমনকি যদি তাদের কম বয়সেও দৃষ্টি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
অভিভাবকদের আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে—পরিবারে মায়োপিয়ার প্রবণতা থাকতে পারে। বাবা-মা যদি ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন হন, তাহলে সন্তানের ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
ক্ষীণদৃষ্টি নিরাময় করা যায় না, এটি চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
বিশেষ লেন্স চোখের বৃদ্ধিতে পরিবর্তন এনে শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার বিকাশকে ধীর করতে পারে। তবে এই লেন্সগুলো বেশ ব্যয়বহুল।
এশিয়ায় এই বিশেষ লেন্সগুলো বেশ জনপ্রিয়। এ অঞ্চলে কাচের ক্লাসরুমও ব্যবহৃত হচ্ছে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, মায়োপিয়ার হার বেশি হলে প্রবীণ বয়সে গিয়ে চোখের বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :