তারেকুর রহমান :
কক্সবাজারের সদর উপজেলার খুরুশকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ত্রয়ী মণি দে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া এই কিশোরী তার জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করছে পুষ্টির প্রকৃত উপকারিতা। স্কুলে প্রতি সপ্তাহে আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ শুরু হওয়ার পর, তার মধ্যে এসেছে এক দৃশ্যমান পরিবর্তন।
ত্রয়ী মণি বলেন, ‘আগে ক্লাসে ঝিমিয়ে পড়তাম, সামান্য পরিশ্রমে ক্লান্ত হতাম। কিন্তু এখন আয়রন ট্যাবলেট নেওয়ার পর থেকে আমি কর্মক্ষমতা অনুভব করছি। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছি।’
তার মতো আরও অনেক কিশোরী এই কর্মসূচির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন অনুভব করছে।
এ পরিবর্তনের মূলে রয়েছে বহুখাতভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রমের প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা। কক্সবাজারে এই কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে বুধবার (১৩ নভেম্বর) জয়েন্ট সুপারভিশন ভিজিট বা যৌথ পরিদর্শন সফরের আয়োজন করে কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ‘অ্যাডপটিং এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ ফর নিউট্রিশন (আমান)’ প্রকল্পের সহায়তায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
খুরুশকুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নাজিম উদ্দিন জানান, তার স্কুলের ৬১২ জন কিশোরী শিক্ষার্থী এই কর্মসূচির আওতায় আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এতে শিক্ষার্থীরা শুধু স্বাস্থ্যগত উন্নতিই পাচ্ছে না, বরং তারা পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও সচেতন হচ্ছে।’
মা ও খামারিদের গল্প, উঠে এলো সফলতার কাহিনী :
শুধু স্কুলে নয়, এই উদ্যোগের সুফল পৌঁছে গেছে গ্রামীণ খামারিদের জীবনেও। কক্সবাজারের ঈদগাঁও জাগিরপাড়ায় অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে অংশ নেওয়া পারভিন আক্তার শোনালেন তার সফলতার গল্প। পারভিনের ১২টি গরু রয়েছে, যা থেকে দৈনিক ৩৫-৩৬ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দুগ্ধ উৎপাদনের আয় দিয়ে আমাদের জীবনধারা উন্নত হয়েছে। স্বামীর বিদেশ যাত্রার খরচও মিটিয়েছি।’ এই খামারিদের সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করছে আমান প্রকল্প, যা খামারিদের আরও শক্তিশালী করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কক্সবাজারের জনগণকে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রতি সচেতন করতে হলে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। সঠিক পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে অনেকেই এখনো পুষ্টিকর খাবার বেছে নিতে সক্ষম হন না।’
তিনি স্থানীয় কৃষি উৎপাদনে পুষ্টিকর খাদ্যশস্য, সবজি ও ফলের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন, যাতে সহজলভ্যভাবে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ সম্ভব হয়।
ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে এই যৌথ পরিদর্শনে অংশ নেন চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক ডা. অং সুই প্রূ মারমা, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ কার্যালয়ের পরিচালক ডা. মো তাহেরুল ইসলাম খান, কক্সবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা। তারা স্থানীয় পর্যায়ে পুষ্টি কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন।
এই যৌথ পরিদর্শনের মাধ্যমে কক্সবাজারের পুষ্টি কার্যক্রমে সাফল্যের নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে খামারিদের মতো বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, এ ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়ন সম্ভব হবে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হবে।
//
আপনার মতামত লিখুন :