ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজ :
মানবসভ্যতা আজ ধর্মীয় বিশ্বাসে নানান ভাগে বিভক্ত।
ধর্মের উদ্ভব একটি জটিল প্রক্রিয়া যা মানব ইতিহাসের বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।
মানব সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই যে ধর্মীয় রীতিনীতির উদ্ভব এমনটা ধারণা করা যায়।
প্রখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুর্খেইমের সংজ্ঞা অনুযায়ী- “ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।”
ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে ঐতিহাসিকভাবে আব্রাহামিক বা ইব্রাহিমীয় ধর্ম নামে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ ইব্রাহিমীয় ধর্ম বলতে প্রধানত ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মকে বোঝায়।
এই ধর্মগুলি একেশ্বরবাদী এবং তাদের সবার ধর্মীয় উৎপত্তিস্থল ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে সম্পর্কিত।
ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মতে, মানব জাতির আদি পুরুষ এডাম বা আদম। কিন্তু এই ৩ ধর্মের অনুসারীরা তাদের জাতির পিতা হিসেবে আব্রাহাম নবী তথা ইব্রাহিম (আ)-কে নির্দেশ করে।
ইহুদীদের পরিচয়:
ইহুদি শব্দটি পবিত্র কোরআনে ৯ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
আব্রাহাম ওরফে ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক, তার পুত্র যাকোব ওরফে ইসরাইল (ইস্রাঈল বা ইস্রায়েল) ওরফে ইয়াকুব (আ:) এর বংশধরগণ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত। যাকোব ওরফে ইয়াকুব (আ:) এর জ্যেষ্ঠপুত্র ইয়াহুদা’র নাম থেকে ইহুদি শব্দটি এসেছে।
ধারণা করা হয়, ইহুদি ধর্মের উদ্ভব প্রায় ৪০০০ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে ২০ অব্দ পর্যন্ত বাইবেলীয় ইহুদিধর্মের চরম বিকাশ ঘটে।
ইহুদিরা মুসা নবীর উম্মত এবং মুসা নবী ও তৎকালীন মানব জাতির উপর নাজিলকৃত আসমানী কিতাব হলো “তাওরাত” (খ্রিষ্ট পূর্ব আনু: ১২ শতাব্দীতে)।
খ্রিস্টানদের পরিচয়:
প্রথম শতাব্দীতে যিশু খ্রিষ্ট তথা ঈসা (আ:) এর জীবন ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করে খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব হয়েছিল।
তার অনুসারীরাই “খ্রিস্টান” নামে পরিচিত হন এবং তাদের বিশ্বাস মূলত যিশুর শিক্ষা, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
যিশু তথা ঈসা (আ:)কে তারা ঈশ্বরের পুত্র এবং মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করে।
খ্রিস্টানরা মূলত ঈসা নবীর উম্মত এবং ঈসা নবী ও তৎকালীন মানব জাতির উপর নাজিলকৃত আসমানী কিতাব হলো ” ইঞ্জিল” ( খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে)।
মুসলমানদের পরিচয়:
মুসলমান বা মুসলিম একটি আরবি শব্দ যার অর্থ “স্ব ইচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী বা অনুগত”। মুসলমান হলো সেই ব্যক্তি যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৷
ঐতিহাসিকগণের মতে, মুসলমানদের উদ্ভব হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে মক্কা ও মদিনায়, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমে। তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ওহী লাভের পর ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মুসলমানরা নিজেদের বিশ্বাসকে আব্রাহামিক ইব্রাহিমীয় নবীদের (যেমন: ইব্রাহীম, মুসা, দাউদ, ঈসা) দেখানো মূল বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখে।
মূলত মুহাম্মদ (স:) এর উম্মতগণ বর্তমানে মুসলমান নামে পরিচিত।
ইসলাম কী:
ইসলাম শব্দটির উদ্ভব হয়েছে আরবি س-ل-م শব্দ হতে যার দু’টি অর্থঃ ১. শান্তি, ২. আত্মসমর্পণ করা।
ইসলামের জনক হলেন স্বয়ং আল্লাহ। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম যা নবী মুহাম্মদ (স:) এর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
অনেকের ধারণা যে, মুহাম্মদ(সাঃ) হলেন এই ধর্মের প্রবর্তক।
তবে মুসলমানদের মতে, সর্বপ্রথম আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম প্রচার করেন আদি মানব ও সর্বপ্রথম নবী আদম (আঃ)। তারপর থেকে অনেক “আম্বিয়া” বা পয়গম্বর যুগের পর যুগ পৃথিবীতে এসে মানবজাতিকে ইসলামী শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন এবং শেষ ও চূড়ান্ত নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে এই ধর্ম পুনঃপ্রচার বা পুন: প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইহুদী, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের মিল ও পার্থক্য:
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
এই তিনটি ধর্মই ইব্রাহীম (আ.)-কে একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তাঁর সাথে নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে যুক্ত করে।
ইহুদি ধর্ম ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাক (আ.) এবং তাঁর বংশধরদের মাধ্যমে এসেছে, যেখানে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মে ইব্রাহীমের অপর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর বংশধরদের মাধ্যমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
বিশ্বাস ও শিক্ষা:
এই তিনটি ধর্মই একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করে, অর্থাৎ তারা এক ঈশ্বরের উপাসনা করে।
ইহুদি ধর্ম ওল্ড টেস্টামেন্টের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে খ্রিস্টান ধর্ম বাইবেল (ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট) এবং ইসলাম ধর্ম কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
এই তিনটি ধর্মেই ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত নবী ও রাসূলের ধারণা বিদ্যমান।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী:
ইহুদি ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও আইন পালনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
খ্রিস্টান ধর্মে যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইসলাম ধর্মে আল্লাহ্র ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও শেষ বিচারের দিনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
এই ধর্মগুলির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য থাকলেও, তাদের মধ্যে একটি সাধারণ ভিত্তি রয়েছে যা হলো ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে তাদের সম্পর্ক এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাস।
আহলে কিতাবের অনুসারী বিপদগামী ইহুদী- খ্রিষ্টান সাথে মুসলমানদের সংঘাত ঈসা (আ:) এর পুনরাগমন পর্যন্ত চলতে থাকবে।
আল্লাহ তা’লা পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য।
সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূত থেকে বেঁচে থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্য পথভ্রষ্টতা অবধারিত হয়ে গেছে। সুতরাং পৃথিবীতে ভ্রমণ করে দেখ, যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে।”
প্রত্যেক নবী-রাসুলগনের উম্মতগনের জন্য অপরিবর্তনীয় সুনির্দিষ্ট একটি বিধান বা নীতিমালা ছিল এইরুপ যে , ঐ সকল উম্মতগনের অবশ্যই তার যুগের নবী-রাসুলগনের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস থাকতে হবে । এবং প্রত্যেক উম্মতের জন্য বাধ্যতামূলক আইন এটাই যে , তার যুগের সকল নবী-রাসুলগনের প্রতি নিঃশর্ত অনুসরন ও আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক ।
মানব জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর যুগে কলেমা ছিল ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আদম শফিউল্লাহ”
মুসলমান, ইহুদী ও খ্রিস্টান জাতির পিতা হযরত আদম (আ:) এর যুগে কলেমা ছিল ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ”।
মুসা নবীর যুগে মুসলমান তথা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষের কলেমা ছিল ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুসা কলিমুল্লাহ”
ঈসা নবীর সময়ে মুসলমান তথা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষের কলেমা ছিল ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ঈসা রুহুল্লাহ”
আমরা যারা মুহাম্মদ (স:) এর উম্মত তাদের কলেমা ” লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”
সুরা বাকারা’র ৬২নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন “নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহূদী হয়েছে এবং খৃষ্টান ও সাবিঈন- যারাই আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের নিকট আছে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।”
মুদ্দা কথা… আল্লাহ তা’লার মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলাম এবং মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সকল নবী-রাসুল ইসলামেরই প্রচার করেছেন।
কিন্তু শয়তানের ধোকায় মানব সম্প্রদায় নানা ধর্মে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীতে আজ সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানব সভ্যতাকে বিপন্ন করছে।
লেখক: সাবেক পরিচালক- কক্সবাজার জেলা ছাত্র ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রভাষক- ইতিহাস, কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজ। ৩৩তম বিসিএস (সা: শিক্ষা)।
আপনার মতামত লিখুন :